অসহযোগ আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং অহিংস আন্দোলন। ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের সমর্থন তুলে নিয়ে তাদের প্রশাসনকে অচল করে দেওয়া। এটি ছিল জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অসহযোগিতা ও তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ শাসকরা ভারতে বেশ কিছু কঠোর আইন প্রণয়ন করেছিল। এর মধ্যে ছিল রাউলাট আইন (Rowlatt Act), যা যেকোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক করার ক্ষমতা দেয়। পাশাপাশি, ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডও ঘটে, যেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নিরীহ ভারতীয়দের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে ভারতের মানুষ ক্রুদ্ধ হয় এবং স্বাধীনতার দাবি আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
মহাত্মা গান্ধী এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে পারেন যে, ভারতীয়দের যদি ব্রিটিশ শাসনের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়, তাহলে তারা নিজেদের মত করে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে সক্ষম হবে। তাই তিনি জনগণকে ব্রিটিশদের সমস্ত রকম সহযোগিতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান এবং অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন।
অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্যসমূহ
অসহযোগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্যগুলো ছিল নিম্নরূপ:
- ব্রিটিশ শিক্ষা ও আদালত বর্জন: আন্দোলনের আওতায় জনগণকে ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আদালতে যাতায়াত বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।
- সরকারি চাকরি ও শিরোপা বর্জন: ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকার থেকে প্রাপ্ত উপাধি ও সম্মান গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদেরও চাকরি ত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
- বিদেশি পণ্য বর্জন: ব্রিটিশ পণ্য বিশেষ করে কাপড়ের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের বর্জন গড়ে তোলা হয়। খাদি কাপড় ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং বিদেশি কাপড় পোড়ানো হয়।
- আত্মনির্ভরতা ও গ্রাম উন্নয়ন: স্বরাজ বা আত্মনির্ভরতার জন্য প্রত্যেককে নিজ নিজ গ্রাম ও নিজেদের উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হয়।
- ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক সংস্কার: আন্দোলনটি ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক সংস্কারের উপরও জোর দেয়। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সৃষ্টিতে গান্ধী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
অসহযোগ আন্দোলনের ধাপসমূহ
১. প্রাথমিক প্রস্তুতি: গান্ধীজি প্রথমে কিছুটা সময় নেন দেশের বিভিন্ন অংশে ঘুরে মানুষকে আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং উপায় সম্পর্কে সচেতন করতে। তিনি বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে বক্তব্য দেন এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের জাগ্রত করেন।
২. আন্দোলনের সূচনা: ১৯২০ সালের আগস্টে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হয়।
৩. জনজাগরণ: জনগণ ব্রিটিশদের স্কুল, কলেজ, আদালত, সরকারি চাকরি, এবং ব্রিটিশ শাসনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। এমনকি গ্রামীণ স্তরে আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
৪. বিদেশি পণ্য বর্জন ও আত্মনির্ভরতা: ভারতীয় পণ্য ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়, বিশেষ করে খাদি ও অন্যান্য ভারতীয় উৎপাদিত সামগ্রীর প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করা হয়।
৫. ধর্মঘট ও সংগ্রাম: ১৯২১ সালে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। অনেক জায়গায় জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করে, ধর্মঘট পালন করে এবং ব্রিটিশ আইন লঙ্ঘন করে।
অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য ও প্রভাব
অসহযোগ আন্দোলন জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়রা বুঝতে পারে যে, ব্রিটিশদের শাসন কেবলমাত্র শারীরিক শক্তি নয় বরং ভারতীয়দের সহযোগিতার উপরও নির্ভরশীল। সুতরাং ব্রিটিশ শাসনকে দুর্বল করার জন্য তাদের উপর থেকে এই সহযোগিতা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আন্দোলনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য:
- ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত হয়।
- ব্রিটিশ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ ভারতীয়রা ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করতে শুরু করে।
- খাদি ও ভারতীয় পণ্যের প্রচলন বৃদ্ধি পায়।
- ব্রিটিশদের প্রশাসনিক এবং বিচার ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি
১৯২২ সালের চৌরি-চৌরা নামে একটি ছোট্ট গ্রামে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কয়েকজন গ্রামবাসীর মৃত্যু হলে গান্ধীজি এই আন্দোলনকে সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, অহিংসার আদর্শ লঙ্ঘন করে কোনরকম সহিংসতার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা উচিত নয়।
উপসংহার
অসহযোগ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম অহিংস প্রতিবাদের মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এটি মানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে সহায়ক হয়েছিল। আন্দোলনটি চূড়ান্তভাবে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মূল ভিত্তি স্থাপন করে। মহাত্মা গান্ধীর এই অহিংস আন্দোলনের ধারা পরবর্তী আন্দোলনগুলোতেও লক্ষ্য করা যায়। অসহযোগ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় যা ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্নকে আরও জোরালো করে তোলে।