শরীরের সুস্থতা অনেকটা নির্ভর করে লিভার এর কার্যক্ষমতার উপর। লিভারের বিভিন্ন রকম রোগের মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ের একটি রোগ হিসেবে লিভার সিরোসিস কে বিবেচনা করা হয়। লিভার সিরোসিস হলো লিভারের একটি মারাত্মক সংক্রমণ যা লিভারে রক্ত সরবরাহ কে ব্যাহত করে ফলশ্রুতিতে লিভারের কার্যক্ষমতা ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হতে থাকে। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হলে যকৃত ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন করা ছাড়া সম্পূর্ণভাবে নিরাময় পাওয়া সম্ভব নয়।
লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হওয়ার পর যকৃতের যে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড রয়েছে যেমন: রক্ত জমাট বাধার উপকরণ তৈরি, ঔষধ ও রাসায়নিক শোষণ, বিপাকক্রিয়ায় স্বাভাবিক অবস্থা, খাদ্যের পুষ্টি উৎপাদনের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ব্যাহত হয়। লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই ফাইব্রোসিসের বিস্তার ঘটে, ফলশ্রুতিতে যকৃতে ছোট ছোট দানা বাঁধে এবং লিভার সংকুচিত হতে থাকে।
লিভার সিরোসিসের কারণসমূহ
হিমোক্রোমাটোসিস বা শরীরে লোহার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া লিভারে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে, পিত্তনালীর অসম বা অস্বাভাবিক গঠন এর ফলে, গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ এর কারণে, আইসোনিয়াজিড বা মেথোট্রেকসেট জাতীয় ঔষধ সেবনের ফলে লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক লক্ষণ গুলো প্রকাশ পেতে থাকে।
অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রভাবে, হেপাটাইটিস সংক্রমণ এর ফলেও লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া লিভার সিরোসিস এর অন্যতম কারণ গুলো হল: অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন, রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বৃদ্ধি, খাদ্যাভাসে অনিয়ম, কায়িক পরিশ্রম না করা ইত্যাদি। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ করলে, রাস্তাঘাটে দূষিত পরিবেশে তৈরি হওয়া শরবত পান করলেও লিভার সিরোসিস এর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
নিচে আমরা লিভার সিরোসিসের কারণসমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব:
হেপাটাইটিস সংক্রমণ
হেপাটাইটিস সি হলো একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা খুব সহজে লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। ক্রনিক হেপাটাইটিস সি লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করার পাশাপাশি লিভারের দাগ ফেলতে সক্ষম। হেপাটাইটিস সি ছাড়াও ক্রনিক হেপাটাইটিস বি লিভারের দাগ ফেলতে একই ভূমিকা পালন করে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি এবং ক্রনিক হেপাটাইটিস সি ছাড়াও অটোইমিউন হেপাটাইটিস এ আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই লিভার সিরোসিসের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে।
অতিরিক্ত ওষুধ সেবন
মেথোট্রেকসেট জাতীয় ঔষধ সেবনের ফলে লিভার সিরোসিস এর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে ভেষজ ঔষধ খেতে থাকলে লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হতে পারেন। যার ফলশ্রুতিতে বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, কিডনি ফেইলর, জন্ডিস এ আক্রান্ত হতে পারেন।
লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হওয়ার আরো কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো:
- পিত্তথলির অস্বাভাবিক গঠন এর ফলে,
- ব্রুসেলোসিস বা সিফিলিস এ আক্রান্ত হওয়ার কারণে,
- অ্যান্টিট্রিপসিনের মাত্রা হ্রাস পাওয়ার কারণে।
লিভার সিরোসিসের লক্ষণ
লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে অনেকের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে থেকেই গুরুতর লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। লিভার সিরোসিসের লক্ষণ গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
প্রাথমিক লক্ষণ
লিভার সিরোসিস এর প্রাথমিক লক্ষণ গুলো হল:
- ক্লান্তি এবং দুর্বলতা,
- সামান্য বা মাজারি আকারে মাথা ব্যথা,
- ক্ষুধামন্দা ভাব,
- পেটে ফোলা ভাব এবং হালকা পেট ব্যথা,
- বমি বমি ভাব,
- চুলকানি,
- হাতের পাতা লাল হয়ে যাওয়া,
- চোখ এবং হাতের তালু হলুদ হওয়া,
- ঝিমুনি ভাব এবং বিভ্রান্তি তৈরি হাওয়া,
উন্নত পর্যায়ের লক্ষণ
প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর চিকিৎসা গ্রহণ না করলে লিভার সিরোসিসের ফলে আরো কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। সেগুলো হল:
- ওজন কমে যেতে পারে,
- অ্যাসাইটিস বা পেটে জল জমে জমতে পারে,
- কথা বলার সময় কথা জড়িয়ে যেতে পারে,
- মেয়েদের ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং ছেলেদের অণ্ডকোষ শুকিয়ে যেতে পারে,
- শরীরের যে কোন জায়গা থেকে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে,
- পা, গোড়ালি এবং পায়ের পাতা ফুলে যেতে পারে,
- লিভার ফেইলর, লিভার ক্যান্সার এর মত কঠিন অসুখ তৈরি হতে পারে সময়মতো লিভার সিরোসিস এর চিকিৎসা না নিলে।
জটিলতা এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
লিভার সিরোসিস এর চিকিৎসা সময়মতো না পেলে রক্তপ্রবাহে টক্সিন জমা হয়। এতে করে স্মৃতিশক্তি জনিত সমস্যা তৈরি হতে পারে। অ্যাডভান্স লিভার সিরোসিস এর ফলে আকস্মিক মৃত্যুও ঘটতে পারে।
লিভার সিরোসিস নির্ণয়
লিভার সিরোসিস নির্ণয় এর জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গন দুইটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। নিচে সেগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয়
প্রথমত, শারীরিক বিভিন্ন লক্ষণ দেখে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ নির্ধারণ করে থাকেন যে রোগী লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছে কিনা। তবে ডাক্তারের যদি বুঝতে সমস্যা হয় সে ক্ষেত্রে সে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ও নিশ্চিত হতে পারে।
ল্যাব টেস্ট এবং স্ক্যানিং
লিভার সিরোসিসের কারণে লিভার কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পরীক্ষা করার জন্য কিডনির কার্যকারিতা, হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি এবং রক্ত জমাট বাঁধার কার্যকারিতা টেস্ট করতে বলা হয়। এ ছাড়া আল্ট্রা সাউন্ড, বায়োপসি টেস্টের মাধ্যমে ও ডাক্তার নিশ্চিত হন।
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা পদ্ধতি
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা পদ্ধতি নিচে তুলে ধরা হলো:
ঔষধ এবং চিকিৎসা পরামর্শ
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় আরসো ১৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট টি সুপারিশ করা হয়ে থাকে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত এবং আপনার শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত না হয়ে আরসো ১৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট টি সেবন করা থেকে বিরত থাকুন।
খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন
- বাইরের খাবার পরিহার করুন,
- তরল জাতীয় খাবার বেশি গ্রহণ করুন,
- বেকিং পাউডার মেশানো আছে এমন কোন খাবার খাওয়া যাবেনা,
- খাবারে লবণের পরিমাণ কমিয়ে আনুন,
- প্রয়োজনের অধিক পানি খাওয়া যাবে না,
- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি প্রয়োজনের অধিক না খেয়ে পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।
- বেকারী আইটেম এড়িয়ে চলুন।
উন্নত পর্যায়ে অস্ত্রোপচার এবং লিভার প্রতিস্থাপন
লিভার সিরোসিস এর কারণে লিভারের কার্যক্ষমতা একেবারে কমে গেলে সে ক্ষেত্রে উন্নত পর্যায়ে অশ্রোপচার এবং লিভার প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হয়। লিভার সিরোসিস যেহেতু একটি অপরিবর্তনীয় অসুখ তাই এর থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার জন্য অস্ত্রোপচার এবং লিভার প্রতিস্থাপন ই সবচেয়ে ভালো উপায়।
লিভার সিরোসিস প্রতিরোধের উপায়
লিভার সিরোসিস মানেই মৃত্যু নয়। লিভার সিরোসিস প্রতিরোধের বিভিন্ন উপায় রয়েছে।
স্বাস্থ্যকর জীবনধারা
প্রতিদিন খাবারে কিছুটা কাঁচা রসুন ও কাঁচা পেঁয়াজ যুক্ত করতে পারেন। এতে করে শরীরের টক্সিন বের হয়ে যাবে। ব্যথা নাশক ঔষধ যখন তখন খাবেন না। অধিক পরিমাণে পানি পান করা ত্যাগ করে পরিমিত পরিমাণে পানি পান করুন। রাস্তাঘাটে সহজ প্রাপ্য খাবার পরিহার করুন। মসলাদার, জাঙ্কফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করুন। ঘরে কম মসলা যুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কয়েক মাস পর পরই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন। এতে করে দীর্ঘদিন সুস্থ থাকতে পারবেন।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আমাদের আজকের এই আর্টিকেলে আমরা লিভার সিরোসিস রোগের কারণ, লিভার সিরোসিস এর লক্ষণ এবং লিভার সিরোসিস রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ সম্পর্কে যদি আপনাদের কোন জিজ্ঞাসা বা মতামত থাকে তাহলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারেন। আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য ধন্যবাদ এবং এরকম আরো তথ্যবহুল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।